আল-মুকাদ্দিমা ফি উসুলুত-তাফসির-১ : ইমাম ইবনু তাইমিয়্যার জীবনী

আল-মুকাদ্দিমা ফি উসুলুত-তাফসির-১ : ইমাম ইবনু তাইমিয়্যার জীবনী


['আল-সালাম ইনস্টিটিউট'-এ ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা'র 'আল-মুকাদ্দিমা ফি উসুলুত-তাফসির' পুস্তিকার উপর শায়খ মুহাম্মাদ আকরাম নাদউই'র একটা কোর্স আছে। আল্লাহর অনুগ্রহে কোর্সটা করার সুযোগ মিলেছিল। এই সিরিজে কোর্সে আলোচিত প্রধান প্রধান কনসেপ্টগুলো পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হবে ইন শা আল্লাহ।] 


------------------------


১. শায়খ আকরাম নাদউই'র মতে, সালাফদের যুগের পর ইসলামের ইতিহাসে দুজন বিদ্বানকে 'মহা-বিদ্বান' (Super-Intellectuals) বলা যায়। এদের একজন হলেন ইবনু সিনা, আরেকজন ইবনু তাইমিয়্যা। তবে দুজনের মধ্যে পার্থক্য হলো, ইবনু সিনা লিখতেন সমাজের উঁচু শ্রেণির (Elite class) মানুষের জন্য। অন্যদিকে ইবনু তাইমিয়্যা লিখতেন উম্মাহর জন্য, নিজের জন্য। 


২. ইবনু তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ'র ব্যাপারে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অনেক মানুষ তাঁকে না পড়েই তাঁর সমালোচনা করে, সম্মানহানি করে। তাঁর প্রতি অন্ধ-বিদ্বেষ রাখে। অথচ, তাদের উচিত ছিল কুরআন-সুন্নাহর প্রতি ইবনু তাইমিয়্যা'র খেদমতের কারণে হলেও তাকে ন্যূনতম সম্মান দেওয়া। শায়খের মতে, কুরআন-সুন্নাহ অনুসরণের গুরুত্ব ইবনু তাইমিয়ার লেখনির মাধ্যমে যতটুকু উপলব্ধি করা যায়, আর কারো লেখার মাধ্যমে ততটা যায় না। 


৩. ইবনু তাইমিয়্যাকে যথাযথভাবে বুঝলে হলে তাঁর সময়কাল সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। ইবনু তাইমিয়্যা জন্মগ্রহণ করেন ৬৬১ হিজরি সনে, ১২৬৩ খ্রিষ্টাব্দে। মুসলিম জাতির ইতিহাসে এই সময়টা ছিল খুবই সংকটপূর্ণ। রাজনৈতিকভাবে মুসলিমরা ছিল দুর্বল। তাঁদের আগের জৌলুশপূর্ণ সময়ের ইতি ঘটেছে। মঙ্গোল আক্রমণে মুসলিম বিশ্ব ছিন্নভিন্ন। মুসলিমদের মধ্যে কুরআন, সুন্নাহ, মাযহাব, তাসাউউফ ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর ভুল ধারণা বিস্তার লাভ করেছে। মুসলিম পণ্ডিতরা প্রতিনিয়ত অনৈসলামিক উৎস থেকে নতুন নতুন আইডিয়া আমদানি করছেন। সমস্যার অন্ত নেই। ঠিক এই সংকটপূর্ণ সময়ে ইবনু তাইমিয়া তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি মুসলিম জাতিকে এই দুর্যোগ থেকে উদ্ধারে কাজ করতে থাকেন। 


ইবনু তাইমিয়্যাকে জানা জরুরি, কারণ তাঁর সময়ের সাথে আমাদের যুগের অনেক মিল রয়েছে। একই রকমের সমস্যার মুখোমুখি আমরাও হচ্ছি। 


৪. ইবনু তাইমিয়্যার দুটো বৈশিষ্ট্য ছিল—

(১) যুহদ এবং 

(২) জিহাদ


ইবনু তাইমিয়ার জীবন ছিল খুব সাদাসিধা। অর্থবৃত্তের প্রতি লোভ তার ছিল না। অন্য অনেক আলিমের মতো তিনি সুলতান-শাসকদের লেজুড়বৃত্তি করতেন না। কেউ তাঁর কিছু চাইলে তাকে তা দিয়ে দিতেন। দেওয়ার মতো কিছু না থাকলে নিজের পোশাক (যেমন: পাগড়ি) থেকে একটা অংশ দিয়ে দিতেন।


অনেক বিদ্বান আছে যারা শ্রেণিকক্ষে অনেককিছু শেখাতে পারেন, অনেক যুক্তিতর্ক করতে পারেন। কিন্তু যখন ময়দানে লড়াইয়ের পালা আসে তখন তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায় না। ইবনু তাইমিয়া তাঁদের মতো ছিলেন না। জিহাদে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সাহসী, সামনের সারির যোদ্ধা। সবচেয়ে জোরে ঘোড়া হাঁকাতেন। শত্রুদের মনে ভীতি জাগিয়ে তুলতেন। 


৫. ইবনু তাইমিয়ার সমসাময়িক বড় বড় ইতিহাসবিদরা সবাই তাঁর মর্যাদা স্বীকার করেন। যেমন: ইমাম আয-যাহাবি, ইমাম ইবনু কাসির, ইমাম মিযযি, বিরযালি (রাহিমাহুল্লাহু জামিয়ান)। তাঁরা ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিকের অন্তর্ভুক্ত। আর তাঁরা সবাই ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ'র মর্যাদা একবাক্যে স্বীকার করেন।


৬. ইমাম আয-যাহাবি তাঁর 'সিয়ারু আলামিন নুবালা' গ্রন্থে ইমাম ইবনু তাইমিয়াকে যেসব উপাধিতে ভূষিত করেছেন সেগুলো হলো—শায়খ, ইমাম, আলিম, মুফাসসির, ফকিহ, মুজতাহিদ, হাফিয, শায়খুল ইসলাম, নাদিরাতুল আসল (দুর্লভ ব্যক্তিত্ব), দুত্তাসানি ফিল-বাহিরা, দাকাউল মুফরিদ। 


শায়খুল ইসলাম: এই উপাধি তাঁদের দেওয়া হয় যাদের জ্ঞানের মাকাম খুব উঁচু। ইতিহাসে খুব বেশি আলিমকে এই উপাধি দেওয়া হয়নি। ইবনু তাইমিয়ার জীবনকালেই তাঁর জন্য মানুষজন এই উপাধি ব্যবহার শুরু করে।


৭. জ্ঞানার্জন: ইবনু তাইমিয়া যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সেখানে জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি ছিল পোক্ত। তাঁর  পিতা আব্দুল হালিম আর পিতামহ মাজদউদ্দিন দুজনই ছিলেন হানবালি মাযহাবের আলিম। ইবনু তাইমিয়া শৈশবে কুরআন হিফয করেন। তিনি ছয় কুতুবসহ অনেকগুলো হাদিসগ্রন্থ আত্মস্থ করেন। মুসনাদ আহমাদের ক্ষেত্রে তাঁর ইসনাদ ছিল সে যুগের সেরা ইসনাদ। তিনি ইসলামের শাস্ত্রগুলো গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। তাছাড়া গণিত, দর্শন, ক্যালিগ্রাফি ও ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ও শিখেন। তাঁর শিক্ষকের সংখ্যা ছিল দুই শতাধিক। 


তিনি শৈশবেই তর্কে বড়দের হারিয়ে দিয়ে তাদের বাকরূদ্ধ করে দিতেন। কৈশোরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি ফাতওয়া দিতে শুরু করেন। আর তা-ও দামেস্ক শহরে, যা কিনা আগে থেকেই জ্ঞানী-গুণী দ্বারা ছিল পরিপূর্ণ। তার বাবা ছিলেন মাদরাসার শিক্ষক। তাঁর বাবার মৃত্যুর পর ২১ বছর বয়সে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন।


তাঁর লেখালেখি আর বক্তৃতা ছিল সুন্দর, অলংকারপূর্ণ। হাদিস আর রিজাল সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল বিপুল। ইমাম আয-যাহাবি বলেন: বলা হতো, "যে হাদিস ইবনু তাইমিয়া জানেন না, সেটা কোনো হাদিসই না।"


চার মাযহাবের ফিকহ সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত জ্ঞান রাখতেন। এমনকি, অন্যান্য মাযহাবের আলিমরাও তাঁর মজলিস থেকে নিজেদের মাযহাব সম্পর্কে অনেককিছু শিখতে পারতেন। জ্ঞানের অন্যান্য শাখা সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। 


৮. ইমাম ইবনুল কায়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ প্রতিদিন ফযরের সালাতের পর মসজিদে বসে যিকির করতে থাকতেন। যখন সূর্য খুব উপরে উঠতো, তখন তিনি সেটায় ক্ষান্তি দিতেন। তিনি বলতেন: "এটা আমার সকালের খাবার। এটা না থাকলে আমার সকল শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে।" 


৯. ইমাম আয-যাহাবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন: "আমার মতো একজন বর্ণনা করবে, তাঁর চেয়ে তিনি (ইবনু তাইমিয়্যা) অনেক অনেক উত্তম। আমি ইবনু তাইমিয়্যার মতো কাউকে দেখিনি, এমনকি তিনিও তাঁর মতো কাউকে দেখেননি। আমাকে যদি মাকাম ইবরাহিম আর হাজার আসওয়াদের মাঝে দাঁড়িয়ে শপথ করে একথা বলতে বলা হয়, আমি তা বলতে পারব।"


১০. ইবনু দাকিক আল-ঈদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন: "আমি যখন ইবনু তাইমিয়ার সাথে দেখা করলাম, তখন এমন একজন মানুষকে পেলাম, যার দুচোখের সামনে সকল জ্ঞান একত্রিত হয়েছে। তিনি সেখান থেকে যা ইচ্ছা গ্রহণ করেন, আর যা ইচ্ছা পরিত্যাগ করেন।" তিনি ইবনু তাইমিয়াকে বলেন: "আল্লাহ আপনার মতো কাউকে বানাবেন এমনটা আমি কখনো ভাবতে পারিনি।"


১১. ইবনু তাইমিয়ার প্রশংসা যে কেবল হানবালিরা করে এমন না। বরং, অন্যান্য মাযহাবের ইমামরাও তাঁর প্রশংসা করেছেন। তাঁর মানে এই না যে তাঁরা ইবনু তাইমিয়ার সাথে সব বিষয়ে একমত। বরং তাঁর প্রশংসাকারীদের অনেকে অনেক বিষয়ে তাঁকে খণ্ডনও করেছেন।  ইমাম আয-যাহাবি, ইবনু কাসির, ইবনু দাকিক আল-ঈদ, ইবনু হাজার আল-আসকালানি, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেওলাউই, কামাল-উদ্দিন যামলাকানি, আল-মিযযি, বদরুদ্দিন আইনি—তারা ইবনু তাইমিয়্যার প্রশংসা করেছেন। এদের কেউ হানবালি ছিলেন না। 


১২. ইবনু তাইমিয়্যা মাঝে মাঝে কোনো আয়াত বুঝতে একশত তাফসির পর্যন্ত ঘাটতেন। তিনি কোনোকিছু না বুঝলে দুআ করতেন: "ও আল্লাহ—ইবরাহিম ও আদামের শিক্ষক, আমাকে শেখান।"


১৩. ইবনু তাইমিয়্যা জীবনের নানাসময়ে অন্তত সাতবার জেল খেটেছেন। সবগুলো ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন ষড়যন্ত্রকারীদের বিদ্বেষের শিকার। তা সত্ত্বেও মৃত্যুর আগে তিনি তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেন। তিনি বলেন: "আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম, কেবল যে আল্লাহ আর তাঁর রাসুলের শত্রু সে বাদে।"


১৪. ইবনু তাইমিয়ার দুটো মহৎ গুণ—

—আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা 

—ন্যায্যতা


১৫. ৭২৮ হিজরি সন মোতাবেক ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দে ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জানাজায় দুই লক্ষাধিক মানুষ উপস্থিত হন। ষোল হাজার নারী তাঁর জানাযায় উপস্থিত হন। ইমাম ইবনু কাসির বলেন, ইসলামের ইতিহাসে কেবল ইমাম আহমাদ ইবনু হানবালের জানাযায়ই এর চেয়ে বেশি মানুষ উপস্থিত হয়েছিল।


দামেস্কের সুফি গোরস্থানে ইবনু তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ'কে সমাহিত করা হয়।




Comments