আল-মুকাদ্দিমা ফি উসুলুত-তাফসির ২


['আল-সালাম ইনস্টিটিউট'-এ ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা'র 'আল-মুকাদ্দিমা ফি উসুলুত-তাফসির' পুস্তিকার উপর শায়খ মুহাম্মাদ আকরাম নাদউই'র একটা কোর্স আছে। আল্লাহর অনুগ্রহে কোর্সটা করার সুযোগ মিলেছিল। এই সিরিজে কোর্সে আলোচিত প্রধান প্রধান কনসেপ্টগুলো পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হবে ইন শা আল্লাহ। আজ পর্ব-২ ]


------------------------------


১. ইমাম রাযি, ইমাম গাযালি, ইবনু আরাবি, ইবনু সিনা—তাঁদের লেখা পড়লে কুরআনকে একটা রহস্য মনে হবে। মনে হবে, কুরআন একটা ধাঁধা, একটা কোড। বিশেষ এক শ্রেণির মানুষজন ছাড়া কারো পক্ষে কুরআন বোঝা সম্ভব না। এখানেই তাঁদের সাথে ইবনু তাইমিয়্যার পার্থক্য। ইবনু তাইমিয়্যার মতে, কুরআনের ভাষা সুস্পষ্ট আরবি—"বি-লিসানুন আরাবিয়্যুন মুবিন।" কুরআন এমন কোনো বিশেষ ধরণের পরিভাষা,যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য না, তা ব্যবহার করে না। কুরআনের ভাষা হলো হিদায়াতের ভাষা৷ 


২. শব্দের উদ্দিষ্ট অর্থ বনাম বিশেষ সমাজে প্রচলিত অর্থ : দার্শনিক, ফুকাহা, সুফিগণ, মুতাকাল্লিমগণ যখন কুরআন পড়তে যান, তখন তাঁরা তাঁদের মাথায় আগে থেকে থাকা কিছু আইডিয়া কুরআনের উপর চাপাতে চেষ্টা করেন। যেমন: দার্শনিকরা কুরআনে শুধু দর্শন খুঁজে পান। কুরআনের যেখানেই দর্শনের সাথে সাদৃশ্য আছে এমন কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা থাকে সেটাকেই তাঁরা নিজেদের মতবাদের পক্ষে টানার চেষ্টা করেন। একইভাবে ফকিহরা কুরআনে নিজেদের মাযহাবের পক্ষে প্রমাণ খুঁজতে থাকেন। তাঁরা হানাফি, মালিকি, শাফিয়ি, হানবালি, আশয়ারি কিংবা মাতুরিদির দৃষ্টি দিয়ে কুরআন পড়েন। ফেমিনিস্টরা কুরআনকে ফেমিনিজম অনুযায়ী ব্যাখ্যা করেন।  এটা খুব সমস্যাজনক। কুরআন থেকে হিদায়াত নিতে হলে মনকে পূর্ব-ধারণা (preconceived notions) থেকে মুক্ত করতে হবে। তারপর খালি-মনে কুরআন বোঝার চেষ্টা করতে হবে।


৩. কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা সৃষ্টি করেছেন গল্পকার ওয়ায়েজগণ। তাঁরা মানুষকে শেখানোর আগেই তাদের অন্তর গলাতে চান। লোকেরা তাদের কথার সুরে, মেসেজ না বুঝেই কান্না শুরু করে।


এই প্রসঙ্গ শায়খ আকরাম একটা মজার কাহিনি শেয়ার করেছেন। এক লোক এক জায়গায় গল্প শুনতে গিয়েছে। গল্পকার গল্পের শেষে দেখেন, এই লোকটা কাঁদছে। দেখে গল্পকার খুশি হয়ে ঐ ব্যক্তির কাছে যান। বলেন, কী ব্যাপার, কেউ আমার গল্প শুনে কাঁদেনি, কিন্তু আপনি কাঁদছেন কেন? ঐ লোক জবাব দেয়, আমার একটা ছাগল ছিল, সেটা হারিয়ে গেছে। আপনার দাঁড়ি আর আমার ছাগলের দাঁড়ি দেখতে একরকম। আপনাকে দেখে আমার ছাগলের কথা মনে পড়ে গেছে। তাই কান্না করছি। 


৪. কুরআন পড়ার ক্ষেত্রে আমাদের কর্মপন্থা হবে—আমরা কুরআন পড়তে বসব আল্লাহর দাস হিসেবে। আমরা কুরআন পড়ব কুরআন থেকে নিতে, কুরআনকে দেওয়ার জন্য না।


৫. দুনিয়াতে দুই ধরণের লেখা আছে:

—সাহিত্যিক লেখা (Literary text)

এই ধরণের লেখা বুঝতে এটা কে লিখেছে/বলেছে তা জানা জরুরি না। লেখক সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলেও পড়ে বুঝা সম্ভব। 

—নির্দেশনামূলক লেখা (Text of Instruction) 

এই ধরণের লেখা বুঝতে হলে এর লেখক কে তা জানা জরুরি। তা না হলে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। 


কুরআন বুঝতে হলে আমাদের কুরআনের বক্তা আল্লাহ সম্পর্কে জানতে হবে। জানতে হবে নবি মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কেও। এটা কুরআনের সঠিক বুঝের জন্য অপরিহার্য।


৬. কুরআন নাযিলের দুটি উদ্দেশ্য—(১) মানুষজন যেন এর আয়াতসমূহ নিয়ে ভাবনাচিন্তা (Ponder/তাদাব্বুর) করে এবং (২) এর অনুসরণ (Follow) করে।


৭. অনেকে মনে করেন, কুরআনের ব্যাখ্যামূলক হাদিসের সংখ্যা খুব কম। এটা খুব বড় ভুল ধারণা। আসলে, পুরো সুন্নাহই কুরআনের বায়ান/ব্যাখ্যা। যেমন: কুরআনে সালাত পড়তে আদেশ দেওয়া হয়েছে। তাই সালাত সংক্রান্ত যত হাদিস আছে তার সবই কুরআনের এই সালাত সংক্রান্ত  আয়াতমালার বায়ান। আবার, নবিজি সা. নিজেও কুরআন থেকে অনেক বিধান বের করেছেন।


৮. কুরআন বোঝার তিন ক্রমধারা:

—খালি-মনে কুরআন বোঝা

—কুরআনের প্রথম প্রয়োগ সম্পর্কে জানা

—পূনর্প্রয়োগ


কুরআন বুঝতে হলে সবার আগে নিজের দার্শনিক, ফকিহ কিংবা ফেমিনিস্ট সত্তা ত্যাগ করে উপদেশ-গ্রহণকারীর সত্তা ধারণ করতে হবে। কুরআনকে দেওয়ার বদলে কুরআন থেকে নেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। এভাবে কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে হবে। 


তারপর দেখতে হবে কুরআনের প্রথম প্রয়োগকারী নবি মুহাম্মাদ সা. কীভাবে কুরআন প্রয়োগ করেছেন। সেটা অনুযায়ী কুরআন বুঝতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মুহাম্মাদ সা. কোনো পোস্টম্যান ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক। পোস্টম্যান কেবল চিঠি পৌঁছিয়ে দিলে তার কাজ শেষ যায়। কিন্তু শিক্ষক কোনোকিছু শেখাতে চাইলে তা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেন। নবিজি সা.-ও তাঁর অনুসারীদের কুরআন যথাযথভাবে বুঝিয়েছেন। তাই কুরআন বুঝতে হবে নবিজি সা. যেভাবে বুঝিয়েছেন সেভাবে। 


তৃতীয় ধাপে নবিজির শেখানো উপায়ে নিজের জীবনে কুরআনের শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। 


৯. কুরআন বুঝতে হলে আমাদের কুরআনের মর্যাদার কথা মাথায় রাখতে হবে। কুরআন কার বই? এটা আল্লাহ আল-আযিয, আল-আলিম, আল-হাকিম, আর-রাহিম, মহাবিশ্ব ও পৃথিবীর স্রষ্টা, পালনকর্তার পাঠানো বই। এই বিশেষণগুলো আর কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। কুরআন মানুষকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করে। কুরআন পড়া মানে আল্লাহর সাথে কথা বলা।  সুতরাং, কুরআনকেও অন্য যেকোনো বইয়ের মতো মনে করা যাবে না। একে যথাযথ সম্মান দিতে হবে। অনেক জ্ঞানী মানুষ জীবনের শেষান্তে কুরআনের সাথে আরো বেশি সময় কাটাতে পারেননি বলে আফসোস করেছেন। 


১০. কুরআন আমাদের কেবল তাই শেখাবে যা আল্লাহ আমাদের শেখাতে চান। কুরআন হিদায়াতের বই, হাওয়া'র (প্রবৃত্তি) বই না। কুরআন পাঠের উদ্দেশ্য যেন হয় হিদায়াত পাওয়া, নিজের মতবাদের পক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ না।


১১. কুরআনের তিনটি অনুপম গুণাবলি

—নিখাঁদ ও পরিপূর্ণ (Complete and Perfect)

—কুরআনের অর্থ স্থিরীকৃত (Meanings are settled)

—সুসঙ্গত (Consistent)


১২. কুরআনের ভাষা হলো সুস্পষ্ট আরবি ভাষা। আরো স্পষ্টভাবে বললে, যখন নাযিল হয়েছে তখনকার আরবি ভাষা। 


কুরআনে কোনো শব্দ ব্যবহৃত হলে এর এটা তিন ধরণের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। হয় সেটা—

(১) আভিধানিক অর্থে, 

(২) সমাজে প্রচলিত অর্থে কিংবা 

(৩) শরয়ি অর্থে। 


কুরআনে কোন শব্দ কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা চিহ্নিত করা জরুরি। একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। অনেকে এগুলো গুলিয়ে ফেলেন। তাঁরা সমাজে প্রচলিত অর্থে ব্যবহৃত শব্দকে আভিধানিক অর্থ অনুযায়ী ব্যাখ্যা করেন। কিংবা উল্টোটা করেন। যেমন: কুরআনে সালাত পড়তে আদেশ দেওয়া হয়েছে। এই সালাতের আভিধানিক অর্থ আর শরয়ি অর্থ ভিন্ন। সালাত শব্দটা শরয়ি পরিভাষায় নিতে হবে।


১২. কুরআনিক কনসেপ্ট: তাওয়াল্লি আয-যামান ও তাওয়াল্লি আল-মাকাম


যখন সময় বা স্থান আল্লাহর দিকে ফিরে, তখন আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত মানুষেরা আল্লাহর দিকে ফিরেন। এই কনসেপ্টটাকে বলা হয় তাওয়াল্লি আয-যামান ও তাওয়াল্লি আল-মাকাম। যেমন, সালাতের সময়গুলোর দিকে খেয়াল করুন। এগুলো এমন এমন সময়ে যা কিনা তা বিশ্বাসীদের আল্লাহর মহত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। আসরের সময় যখন তারা সালাত পড়ে, তাদের মাথায় থাকে, সূর্য হেলে গেলেও আল্লাহর ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয় না। মাগরিবের সময় তাদের মাথায় থাকে, সূর্য ডুবে গেলেও আল্লাহ কখনো অস্তমিত হন না। এভাবে সালাত আমাদের আল্লাহর কাছে ফেরায়। তাঁর কথা স্মরণ করায়। 


১৩. কুরআনের ভাষাশৈলির সৌন্দর্য কেবল আরবিতে। অনুবাদ পড়ে কুরআনের ভাষাশৈলি সম্পর্কে জেনে গেছি এমনটা মনে করা ঠিক না।


১৪. মুত্তাকিরা ছাড়া কেউ কুরআন দ্বারা উপকৃত হতে পারেন না। মাওলানা হামিদুদ্দিন ফারাহি (রহ.) বলেন: "তাকওয়া না থাকলে কুরআনকে অর্থহীন মনে হবে।" এক্ষেত্রে তাকওয়া হলো কুরআনের বোঝার জন্য সদিচ্ছা।  কুরআন পড়ার আগে কুরআন কেন পড়ছি তা ঠিক করে রাখতে হবে। আর তা হলো, উপদেশ গ্রহণ। আল্লাহ সম্পর্কে, মুক্তির উপায় সম্পর্কে জানা। 


১৫. শায়খুল ইসলাম তাকিউদ্দিন ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর 'আল-মুকাদ্দিমা ফি উসুলুত-তাফসির' গ্রন্থের ভূমিকায় লেখেন:  “মুসলিম উম্মাহর কুরআনকে বুঝতেই হবে। এটা আল্লাহর শক্ত রজ্জু, প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ আর সরল পথ। কুমতলব কখনোই একে দূষিত করতে পারবে না আর নাই নষ্ট জিহ্বা পারবে একে বিকৃত করতে। যতোই অধ্যয়ন করো এটা কখনই ম্লান হবে না, এর বিস্ময় হবে না শেষ। আর বিদ্বানগণ কখনই এর গভীরে পৌঁছুতে পারবেন না।


"যেই একে উচ্চারন করেছে সে সত্য বলেছে। যে এটা অনুযায়ী আমল করছে সে পুরস্কৃত হবে। যে তা অনুযায়ী বিচার করেছে সে হয়েছে ন্যায়পরায়ণ। যেই এর প্রতি আহ্বান করেছে সেই সরল পথের হিদায়াত পেয়ে গেছে। যেই দাম্ভিকভরে একে ছেড়ে যাবে সে ধ্বংস হবে। আর যে অন্য কোথাও হিদায়াত খুঁজবে সে হবে পথভ্রষ্ট।” [১]


১৬. "বিদ্বানগণ কখনই এর গভীরে পৌঁছুতে পারবেন না"—এখানে মানুষের বুঝের সীমাবদ্ধতা ফুটে উঠে। আমাদের জ্ঞান সবসময় সীমাবদ্ধ। কুরআন বোঝার ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। মানুষ কখনো কুরআনের পুরো অর্থ বুঝতে পারবে না। এমন অনেক বিষয় আছে, যা আমরা কেবল মৃত্যুর পরেই বুঝতে পারব। আছে এমন বিষয় যা বুঝব জান্নাতে গেলে, কিংবা জাহান্নামে গেলে (এটা থেকে আমরা আশ্রয় চাই)। আবার এমন অনেক বিষয় আছে যা আমরা কখনোই বুঝতে সক্ষম হবো না। 


এখন প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য কী? ব্যাপার হলো, আমরা সবাই কুরআনের একটা নির্দিষ্ট আর আমাদের জন্য জরুরি অর্থ বুঝতে পারি। আর এটায়ও ব্যাক্তিভেদে তারতম্য হবে। নবি সা. সবচেয়ে বেশি কুরআন বুঝতেন। আলিমরা আমজনতার চেয়ে বেশি বুঝবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আলিমরা যা বুঝবেন, নবি সা. যা বুঝতেন কুরআন তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ধারণ করে। আমাদের জন্য যা বোঝা দরকারি তা আমরা অবশ্যই বুঝতে পারব। কিন্তু আমাদের সেই বুঝ থেকে অনেক অনেক বেশি অর্থ কুরআন ধারণ করে।


------------------------------


[১] তাকিউদ্দিন ইবনু তাইমিয়্যা, আল-মুকাদ্দিমা ফি উসুলুত-তাফসির, ভূমিকা অংশ। 

[উল্লেখিত তরজমাটা 'কুরআনের সান্নিধ্যে' নিবন্ধ থেকে নেওয়া, ঈষৎ সম্পাদিত।]




Comments

Post a Comment