বাংলার মানুষজন কীভাবে মুসলিম হলো?
একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন? বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন। এর চারদিকের অঞ্চলগুলো অমুসলিম অধ্যুষিত। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের করা জরিপে জানা গেল, বাংলার অধিকাংশ জনগণ মুসলিম। এটা ব্রিটিশদের কাছে ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত। স্বাভাবিকভাবেই এদেশের মানুষ কীভাবে মুসলমান হলো— সেটা নিয়ে নানা তত্ত্ব হাজির হতে থাকে।
এসব তত্ত্বের মধ্যে আছে অভিবাসন তত্ত্ব (Immigration theory), তলোয়ারের ধর্ম তত্ত্ব (The Religion of the Sword thesis), পৃষ্ঠপোষকতা তত্ত্ব (Patronage theory) এবং সামাজিক মুক্তির ধর্ম তত্ত্ব (The Religion of Social Liberation theory).
মার্কিন প্রফেসর Richard M. Eaton প্রচলিত এসব তত্ত্বের অপ্রতুলতা তুলে ধরেছেন তার লেখা 'The Rise of Islam and the Bengal Frontier: 1204-1760'' বইয়ে। তিনি এক অভিনব তত্ত্ব হাজির করেছেন।
Immigration theory বা অভিবাসন তত্ত্ব অনুযায়ী এদেশের মুসলিমদের বেশিরভাগই ইরান-তুর্কি-আরব এসব দেশ থেকে আগত লোকদের বংশধর। কিন্তু বাস্তবে এদেশের বেশিরভাগ মুসলিম এদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বংশধর। তাই এই তত্ত্ব ধোপে টেকে না।
The Religion of Sword thesis বা তলোয়ারের ধর্ম তত্ত্ব অনুযায়ী এদেশের জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক মুসলিম বানানো হয়েছে। এর স্বপক্ষে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।
Patronage theory বা পৃষ্ঠপোষকতা তত্ত্ব অনুযায়ী এদেশের মানুষ মুসলিম শাসকদের থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছে। কিন্তু ইটনের মতে এতো বিপুল সংখ্যক মানুষের ইসলাম গ্রহণের ব্যাখ্যা হিসেবে এটা পর্যাপ্ত নয়।
The Religion of Social Liberation বা সামাজিক মুক্তির তত্ত্ব অনুযায়ী, এদেশের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে হিন্দুধর্মের বর্ণপ্রতার জাঁতাকল থেকে মুক্তি পেতে। মুসলিমদের মধ্যে এই তত্ত্ব জনপ্রিয় হলেও ইটন এটার অনেক সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছেন। তার মতে, ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণপ্রথা উত্তর ভারত ও পশ্চিম বাংলায় প্রভাব বিস্তার করলেও বাংলায় তা তখনো ছড়ায়নি। তখনো বর্ণপ্রথার বিস্তার পূর্ব বাংলায় হয়নি।
এবার আসা যাক ইটনের তত্ত্বে। তার মতে এদেশে জমি-আবাদ এবং ইসলাম-আবাদ একসাথে হয়েছে। সেটা হয়েছে মোঘল আমলে, সতেরো-আঠারো শতকে। এক্ষেত্রে অবদান রেখেছে গঙ্গানদীর গতি পরিবর্তন। একসময় গঙ্গা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি-ভাগীরথী শাখা দিয়ে প্রবাহিত হতো। এটাই ছিল গঙ্গার প্রধান প্রবাহ। পরে তা পরিবর্তিত হয়ে পদ্মা প্রধান প্রবাহে পরিণত হয়। এর ফলে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস-চাষাবাদের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়।
এদেশে আগে থেকে রাজবংশী, সাঁওতাল, পদ, চণ্ডাল, কৈবর্তসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বসবাস করতো। দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলায় বসবাসকারী এসব জনগোষ্ঠী চাষাবাদের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। বরং মাছ ধরাসহ বিভিন্ন কাজকর্ম করতো। আধা যাযাবর জীবনযাপন করতো। তাদেরকে জমি-আবাদে উদ্বুদ্ধ করে উত্তর ভারত ও আরব-ইরান-তুর্কি থেকে আগত একদল সুফি-সাধক। তারা মোঘল শাসকদের থেকে করহীন জমি লাভ করে স্থানীয় লোকদের দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করাতো। সেখানে ফসল আবাদ করতো। বসতি গড়ে তুলতো। ঐসব স্থানে মুসলিম নেতারা নির্মাণ করতো মসজিদ কিংবা মাজার। এভাবে স্থানীয়রা চাষাবাদের এবং ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া শুরু করে।
মোঘলরা যখন পশ্চিম বাংলা অধিকার করে তখন সেখানে আগে থেকেই জমিদার শ্রেনী ছিল। মোঘলরা স্রেফ তাদের থেকে আনুগত্য ও খাজনা আদায় করতো। অন্যদিকে পূর্ব বাংলা মূলত ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। জঙ্গল সাফ করে কৃষিজমির বিস্তারে মোঘলরা ইরান-তুর্কি ও উত্তর ভারত থেকে আগত সুফি-পীরদের করহীন জমি দান করতো, যা তারা স্থানীয় লোকদের মাধ্যমে বসবাস ও আবাদযোগ্য করতো৷ এর পাশাপাশি ইসলামের প্রাথমিক দীক্ষাও তারা এসব সুফি-পীরদের কাছ থেকে পেতো। জমি দানের বিনিময়ে মোঘলরা পেত একদল অনুগত লোক।
ইটনের মতে ধর্মান্তরকরণ বলতে যা বোঝায় তা বাংলার মুসলিমদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। বরং তিনটি ধাপে ক্রমান্বয়ে পূর্ব বাংলার মানুষ মুসলিম হয়ে উঠে। প্রথম ধাপে তারা হিন্দু দেবদেবীর পূজা-অর্চনার পাশাপাশি বিভিন্ন মুসলিম পীর-দরবেশে শ্রদ্ধা-ভক্তি করতো। একসময় পীর-দরবেশরাই প্রধান আসল দখল করে নেয়। হিন্দু দেবদেবীর শ্রদ্ধা ভক্তি লোপ পায়। তৃতীয় ধাপে উনিশ শতকে বিভিন্ন সংস্কারপন্থী আন্দোলন এসব মুসলিম সমাজ থেকে অনৈসলামি কর্মকাণ্ড অপসারণে কাজ করে। বিশেষত উত্তর ভারতের তরিকা-মুহাম্মদিয়া আন্দোলন, বাংলার ফরায়েযী আন্দোলন এক্ষেত্রে অবদান রাখে। ফলে মুসলিম পরিচয়ের ব্যাপারে এদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী সচেতন হয়ে উঠে।
-----
(বইটা কিছুদিন আগে পড়েছিলাম। বইয়ের মূল দাবির ব্যাপারে কিছু লিখবো লিখবো করেও লেখা হয়নি। আজ চট করে লিখে ফেললাম। স্মৃতি থেকে কিছু অংশ লিখেছি বলে ভুল থাকা স্বাভাবিক।
এটা রিসার্ড ইটনের নিজস্ব তত্ত্ব। এর পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি আসতে পারে। চূড়ান্ত কোনো কিছু না। আপাতত আমার কাছে এটা শক্তিশালী তত্ত্ব বলে মনে হয়েছে।)
২২.১০.২০২৪
- Get link
- X
- Other Apps
Comments
Post a Comment